যে কারণে মহানবী (সা.) ঝড়-বৃষ্টির সময় চিন্তিত হতেন | বজ্রপাত ও বৃষ্টির সময় হাদিসে বর্ণিত দোয়া

Estimated read time 1 min read

যে কারণে মহানবী (সা.) ঝড়-বৃষ্টির সময় চিন্তিত হতেন

বৃষ্টি আল্লাহ তাআলার অপূর্ব সৃষ্টি। এটা বিশ্ববাসীর জন্য একটি নিয়ামত। সবাই বৃষ্টির মহত্ত্ব বুঝতে পারে। অতি ঝড়বৃষ্টির কারণে আবার ভয়াবহ বন্যা দেখা দেয়।ভূমিধস, পাহাড়ধস, ভাঙনসহ প্রাকৃতিক নানা দুর্যোগ সৃষ্টি হয়। ঝড়বৃষ্টির সময় মহানবী (সা.)-এর বিশেষ কর্মপন্থা দেখা যায়। ঝড়বৃষ্টির মৌসুমে হাদিসে অনেক দোয়া বর্ণিত হয়েছে। এসব আমলের ব্যাপারে সবার মনোযোগী হওয়া উচিত।

বৃষ্টির পূর্বাভাসে নবীজির চিন্তা
মেঘ ও প্রবল বায়ু প্রবাহিত হওয়ার সময় রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর চেহারায় অস্থিরতা প্রকাশ পেত। ‌ মুখের হাসি মুছে যেত। আয়েশা (রা.) বলেন, আমি রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে কোনো দিন এরূপ মুখ খুলে হাসতে দেখিনি, যাতে তাঁর আলজিভ দেখা যায়; বরং তিনি সর্বদাই মুচকি হাসতেন। আর তিনি যখন আকাশে মেঘ বা প্রবল বেগে বায়ু প্রবাহিত হতে দেখতেন তখন তাঁর চেহারায় ভীতি পরিলক্ষিত হতো।

আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! মানুষ সাধারণত আকাশে মেঘ দেখলে বৃষ্টির আশায় আনন্দিত হয়। আর আপনি যখন মেঘ দেখেন তখন আপনার চেহারায় আমার নিকট আপনার অসন্তুষ্টির ভাব ধরা পড়ে। এর কারণ কী? তিনি বলেন, ‘হে আয়েশা! তা শাস্তি বয়ে আনছে কি না এর নিরাপত্তা আমাকে কে দেবে? এক কওমকে বায়ুর মাধ্যমে শাস্তি দেওয়া হয়েছে (যেমন আদ ও হুদ), আরেক কওম মেঘ দেখে বলেছিল, এটা তো মেঘ! আমাদের বৃষ্টি দেবে। ’ (আবু দাউদ, হাদিস : ৫০৯৮)

ঝড়-বাতাসে পড়ার দোয়া
আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন প্রবল বেগে বায়ু বইতে দেখতেন তখন বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা ইন্নি আসআলুকা খইরাহা ওয়া খইরামা ফি হা ওয়া খইরামা উরসিলতা বিহি ওয়া আউযুবিকা মিন শাররি মা ফিহা ওয়া শাররি মা উরসিলাত বিহি। ’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! আমি আপনার কাছে প্রার্থনা করি এর কল্যাণ, এর মধ্যকার কল্যাণ এবং যা এর সঙ্গে প্রেরিত হয়েছে তার কল্যাণ। আর আমি আপনার আশ্রয় চাই এর অনিষ্ট থেকে, এর ভেতরে নিহিত অনিষ্ট থেকে এবং যা এর সঙ্গে প্রেরিত হয়েছে তার অনিষ্ট থেকে।
(তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৪৯)

বৃষ্টিতে বরকত লাভের দোয়া
বৃষ্টির পানিতে বরকত আছে। রাসুল (সা.) বৃষ্টির পানি হাত দিয়ে স্পর্শ করেছেন। আনাস (রা.) বলেন, একবার আমরা রাসুলুল্লাহ (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম। তখন বৃষ্টির নামল। রাসুলুল্লাহ (সা.) তাঁর কাপড় প্রসারিত করলেন, যাতে সেটা পানি স্পর্শ করে। আমরা বললাম, আপনি কেন এমন করলেন? তিনি বলেন, কারণ এটা তার মহান রবের কাছে থেকে এখনই এসেছে (মুসলিম, হাদিস : ৮৯৮)

আয়েশা (রা.) বলেন, রাসুল (সা.) বৃষ্টি দেখলে বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা সইয়্যিবান নাফি আন। ’ অর্থাৎ হে আল্লাহ! মুষলধারায় কল্যাণকর বৃষ্টি দাও। (বুখারি, হাদিস : ৯৭৫; আবু দাউদ, হাদিস : ৩৩৯)

মেঘের গর্জনে পড়ার দোয়া
মেঘের গর্জন একেক সময় একেক রকম হয়ে থাকে। গর্জন ছোট হোক কিংবা বড়—শোনা মাত্র এ দোয়া পাঠ করতে হয়। ইবনে ওমর (রা.) তাঁর পিতা থেকে বর্ণিত, রাসুলুল্লাহ (সা.) যখন মেঘের ও বজ্রের আওয়াজ শুনতেন তখন বলতেন—‘আল্লাহুম্মা লা তাকতুলনা বি গজাবিকা ওয়ালা তুহলিকনা বি আজাবিকা ওয়া আাাফিনা কবলা জালিক। ’

অর্থ : হে আল্লাহ! দয়া করে আপনি আমাদের আপনার গজবের দ্বারা মৃত্যু দেবেন না এবং আপনার আজাব দ্বারা ধ্বংস করবেন না, বরং এর আগেই আমাদের শান্তি ও নিরাপত্তা দান করুন। (মুসনাদে আহমাদ,হাদিস : ৫৭৬৩; তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৫০)

অতিবৃষ্টি বন্ধের দোয়া
আনাস ইবনে মালিক (রা.) থেকে বর্ণিত, একদা জুমার দিনে দৈনিক সাহাবি রাসুল (সা.)-কে বৃষ্টির জন্য দোয়া করতে বলেন। তিনি হাত তুলে দোয়া করেন। সঙ্গে সঙ্গে বৃষ্টি শুরু হয়ে পরবর্তী জুমা পর্যন্ত বৃষ্টি হতে থাকে। পরের জুমায় আবার অতিবৃষ্টি বন্ধের জন্য আবেদন করা হলে তিনি দোয়া করেন—‘আল্লাহুম্মা হাওয়া লাইনা ওয়ালা আলাইনা। ’ অর্থ : হে আল্লাহ! এ বৃষ্টি আমাদের আশপাশে (যেখানে প্রয়োজন) বর্ষণ করুন এবং আমাদের ওপর বর্ষণ করবেন না। (বুখারি, হাদিস : ৯৬৬)

বজ্রপাত ও বৃষ্টির সময় হাদিসে বর্ণিত দোয়া

বর্ষা মহান আল্লাহর এক অফুরন্ত নিয়ামত। গ্রীষ্মের দাবদাহে যখন জনজীবন হয় ওষ্ঠাগত, প্রকৃতি হয়ে ওঠে শুষ্ক আর তামাটে; তখনই অসংখ্য নিয়ামতের ডালি নিয়ে হাজির হয় রহমতের বৃষ্টি। শুরু হয় আকাশে সাদা-কালো মেঘের বিচরণ আর ঝরঝর অবিরল বারিধারা। দাবদাহ কমে গিয়ে জনজীবনে ফিরে আসে স্বস্তি আর প্রকৃতি ফিরে পায় তার সজীবতা।আল্লাহ প্রদত্ত অপার এই নিয়ামতের সময় আমাদের কিছু করণীয় আমল রয়েছে, যা স্বয়ং নবী (সা.) আমাদের শিক্ষা দিয়েছেন। নিম্নে বৃষ্টির সময়ের আমলগুলো তুলে ধরা হলো—

বৃষ্টির সময় দোয়া : আয়েশা (রা.) বলেন, নবী (সা.) যখনই বৃষ্টি হতে দেখতেন তখন পাঠ করতেন ‘আল্লাহুম্মা সায়্যিবান নাফি‘আহ।’ অর্থ : হে আল্লাহ, আপনি যে মুষলধারায় বৃষ্টি দিয়েছেন তা যেন আমাদের জন্য কল্যাণকর হয়। (বুখারি, হাদিস : ১০৩২)

বৃষ্টিতে ভেজা : হালকা বৃষ্টিতে শরীরের কিছু অংশ ভেজানো স্বাস্থ্যের জন্য যেমন উপকারী, তেমনি ইসলামের দৃষ্টিতেও এটি সুন্নত।আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, একবার আমরা রাসুল (সা.)-এর সঙ্গে ছিলাম, তখন আমাদের বৃষ্টি পেল। তিনি বলেন, তখন রাসুল (সা.) তাঁর গায়ের পোশাকের কিছু অংশ সরিয়ে নিলেন, যাতে গায়ে বৃষ্টি লাগে। তখন আমরা বললাম, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনি কেন এমনটি করলেন? তিনি বলেন, কারণ বৃষ্টি তার প্রতিপালকের কাছ থেকে সদ্য আগত। (মুসলিম, হাদিস : ৮৯৮)

বৃষ্টি বৃদ্ধি পেলে দোয়া : আর বৃষ্টির প্রবলতা যখন বৃদ্ধি পেত, নবী (সা.) বলতেন, ‘আল্লাহুম্মা হাওয়ালাইনা, ওয়া লা আলাইনা, আল্লাহুম্মা আলাল আকাম ওয়াজ জুরাব ওয়া বুতুনিল আওদিআ ওয়া মানাবিতিস শাজার।’ অর্থ : হে আল্লাহ! আমাদের আশপাশে বৃষ্টি দিন, আমাদের ওপরে নয়। হে আল্লাহ! পাহাড়-টিলা, খাল-নালা এবং উদ্ভিদ গজানোর স্থানগুলোতে বৃষ্টি দিন।

(বুখারি, হাসিদ : ১০১৪)

বজ্রপাত শুরু হলে সাবধান হয়ে যাওয়া ও দোয়া করা : বিভিন্ন সময়ে আকাশ মেঘাচ্ছন্ন আর রহমতের বৃষ্টির মধ্যে বজ্রপাত শুরু হলে মানুষ ভীত হয়ে ওঠে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষের প্রাণ বিপন্ন হতেও দেখা যায়। এ জন্যই যখন আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হতো কিংবা ঝোড়ো বাতাস দেখা দিত, তখন নবী (সা.)-এর চেহারায় চিন্তার রেখা ফুটে উঠত।তখন তিনি পায়চারি করতেন আর নানা দোয়া পড়তে থাকতেন। আবদুল্লাহ ইবনে যুবায়ের (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, বজ্রপাতের সময় রাসুল (সা.) দুই কান ও কথা বন্ধ রাখতেন এবং বলতেন, ‘সুবহানাল্লাজি ইউসাব্বিহুর রা‘দু বিহামদিহি ওয়াল মালা-ইকাতু মিন খিফাতিহি।’

অর্থ : পবিত্রতা ও মহিমা ঘোষণা করছি সেই প্রভুর, যাঁর ভয়ে তাঁর প্রশংসা পাঠ করে বজ্রপাত ও ফেরেশতাগণ।

(সুরা : রাদ, আয়াত : ১৩)

এরপর বলেন, এটি দুনিয়াবাসীর জন্য চরম হুমকি। (আদাবুল মুফরাদ, হাদিস : ৭২৩)

আবদুল্লাহ ইবনে ওমর (রা.) বলেন, নবী (সা.) যখন বজ্রের আওয়াজ শুনতেন, তখন এই দোয়া পড়তেন, ‘আল্লাহুম্মা লা তাক্বতুলনা বিগজবিকা, ওয়া লা তুহলিকনা বিআজাবিকা ওয়া আ‘ফিনা ক্ববলা জালিকা।’ অর্থাৎ হে আল্লাহ, আপনি আমাকে আপনার গজব দিয়ে হত্যা করে দেবেন না এবং আপনার আজাব দিয়ে ধ্বংস করে দেবেন না। এসবের আগেই আপনি আমাকে পরিত্রাণ দিন।

(তিরমিজি, হাদিস : ৩৪৫০)

বৃষ্টি থেমে গেলে দোয়া : বৃষ্টি থেমে গেলে নবী (সা.) পাঠ করতেন, ‘মুত্বিরনা বিফাদলিল্লাহি ওয়ারাহমাতিহি।’

অর্থ : আল্লাহর অনুগ্রহ ও করুণায় আমাদের মাঝে বৃষ্টি হলো। (বুখারি, হাদিস : ৮৪৬)

বৃষ্টির সময় দোয়া কবুল হয়। নবী (সা.) বলেছেন, দুই সময়ের দোয়া প্রত্যাখ্যাত হয় না। এক. আজান চলার সময়ের দোয়া। দুই. বৃষ্টি বর্ষণের সময়ের দোয়া।

(সহিহ আল জামে, হাদিস : ৩০৭৮)

সর্বোপরি একজন মুসলিম হিসেবে প্রত্যেকেরই উচিত আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হলে বা বৃষ্টি দেখে আল্লাহর দরবারে শুকরিয়া আদায় করা। আর ঝড় বা বজ্রপাত থেকে রক্ষা পেতে মহান আল্লাহর সাহায্য কামনা করা। আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ও বজ্রপাতের সময় তিলাওয়াত, তাসবিহ, তাওবা করার পাশাপাশি নবী (সা.)-এর ওপর বেশি করে দরুদ পাঠ করা।

আল্লাহ আমাদের সবাইকে তাঁর নিয়ামতের শুকরিয়া আদায় করার পাশাপাশি সব অনিষ্ঠতা থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য একমাত্র তাঁরই কাছে আশ্রয় গ্রহণ করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক : প্রাবন্ধিক, অনুবাদক ও মুহাদ্দিস

More From Author

+ There are no comments

Add yours