গীবত একটি জঘন্য গুনাহ | গিবত বা পরনিন্দা মহাপাপ

Estimated read time 1 min read

‘গিবত’ শব্দের আভিধানিক অর্থ পরনিন্দা করা, কুৎসা রটানো, পেছনে সমালোচনা করা, পরচর্চা করা, দোষারোপ করা, কারও অনুপস্থিতিতে তার দোষ অন্যের সামনে তুলে ধরা। ইসলামি শরিয়তে গিবত হারাম ও কবিরা গুনাহ। হাদিসের বর্ণনা, ‘যারা অগ্র-পশ্চাতে অন্যের দোষ বলে বেড়ায়, তাদের জন্য রয়েছে ধ্বংসের দুঃসংবাদ।’ (মুসলিম)। পবিত্র কোরআনে আল্লাহ তাআলা বলেন, ‘আর তোমরা অন্যের দোষ খুঁজে বেড়াবে না।’ (সুরা-৪৯ হুজুরাত, আয়াত: ১২)। ‘দুর্ভোগ তাদের জন্য, যারা পশ্চাতে ও সম্মুখে লোকের নিন্দা করে।…অবশ্যই তারা হুতামাতে (জাহান্নামে) নিক্ষিপ্ত হবে। তুমি কি জানো হুতামা কী? তা আল্লাহর প্রজ্বলিত অগ্নি, যা হৃদয়কে গ্রাস করবে। নিশ্চয় বেষ্টন করে রাখবে, দীর্ঘায়িত স্তম্ভসমূহে।’(সুরা-১০৪ হুমাজা, আয়াত: ১-৯)।

হজরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘তোমরা কি জানো গিবত কাকে বলে?’ সাহাবিরা বললেন, ‘আল্লাহ ও তাঁর রাসুল (সা.) ভালো জানেন।’ তিনি বলেন, ‘তোমার কোনো ভাই সম্পর্কে এমন কথা বলা, যা সে অপছন্দ করে, তা-ই গিবত।’ সাহাবায়ে কেরাম জিজ্ঞেস করলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল, আমি যে দোষের কথা বলি, সেটা যদি আমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তাহলেও কি গিবত হবে?’ উত্তরে রাসুল (সা.) বলেন, ‘তুমি যে দোষের কথা বলো, তা যদি তোমার ভাইয়ের মধ্যে থাকে, তবে তুমি অবশ্যই গিবত করলে আর তুমি যা বলছ, তা যদি তার মধ্যে না থাকে, তবে তুমি তার ওপর তুহমত ও বুহতান তথা মিথ্যা অপবাদ আরোপ করেছ।’ (মুসলিম)। ‘যদি কেউ কারও ওপর মিথ্যা অপবাদ আরোপ করে, ইসলামি দণ্ডবিধিতে তাকে ৮০ দোররা (চাবুক) দেওয়া হবে। এরা ফাসিক, পাপী, অপরাধী। শরিয়তের আদালতে এদের সাক্ষ্য গ্রহণযোগ্য নয়।’

মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গুনাহ হলো গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয়; গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হয় না, যার গিবত করা হয়েছে সে ব্যক্তি যদি মাফ করে, তবেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যেতে পারে
গিবত বা পরনিন্দা ইসলামি শরিয়তে সম্পূর্ণরূপে হারাম ও নিষিদ্ধ। গিবত করা ও গিবত শোনা সমান অপরাধ। অনেকেই পরনিন্দাকে পাপ বা নিষিদ্ধ বলে মনেই করেন না। মদ্যপান, চুরি, ডাকাতি, ব্যভিচার ইত্যাদি থেকেও মারাত্মক ও নিকৃষ্টতম পাপ ও কবিরা গুনাহ হলো গিবত। অন্যান্য পাপ তওবা দ্বারা মাফ হয়; গিবতকারীর পাপ শুধু তওবা দ্বারা মাফ হয় না, যার গিবত করা হয়েছে, সে ব্যক্তি যদি মাফ করে, তবেই আল্লাহর কাছে মাফ পাওয়া যেতে পারে। একটি কবিরা গুনাহ কাউকে জাহান্নামে নেওয়ার জন্য যথেষ্ট।

যখন কেউ আপনার সঙ্গে বসে অন্যের গিবত করে, তখন তাকে থামতে বলুন, আল্লাহর হুকুমের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে সাবধান করুন। আর তাতেও যদি কাজ না হয়, তবে সেখান থেকে সরে আসুন। মহানবী হজরত মুহাম্মাদ (সা.) বলেছেন, ‘পরনিন্দাকারী জান্নাতে প্রবেশ করতে পারবে না।’ (বুখারি ও মুসলিম)।

হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, “যখন আমাকে মিরাজে নিয়ে যাওয়া হলো, তখন আমাকে তামার নখবিশিষ্ট একদল লোকের পাশ দিয়ে নিয়ে যাওয়া হলো। তারা তাদের নখগুলো দিয়ে স্বীয় মুখমণ্ডলে ও বক্ষদেশে আঘাত করে ক্ষতবিক্ষত করছিল। আমি জিজ্ঞেস করলাম, হে জিবরাইল! এরা কারা? জিবরাইল (আ.) বললেন, এরা দুনিয়াতে মানুষের গোশত ভক্ষণ করত এবং তাদের মানসম্মান নষ্ট করত। অর্থাৎ তারা মানুষের গিবত ও চোগলখোরি করত।’” (আবু দাউদ)।

হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুলে করিম (সা.) বলেছেন, দুনিয়াতে যে ব্যক্তি তার ভাইয়ের গোশত ভক্ষণ করবে, অর্থাৎ গিবত করবে, কিয়ামতের দিন গিবতকারী পচা মাংস ভক্ষণ করতে বাধ্য করা হবে। অতঃপর সে অনিচ্ছা সত্ত্বেও চিৎকার করতে করতে তা ভক্ষণ করবে। (বুখারি)।

রাসুলুল্লাহ (সা.)-কে সাহাবিরা জিজ্ঞেস করেছিলেন, ‘হে আল্লাহর রাসুল! গিবত কি জেনার চেয়েও মারাত্মক?’ জবাবে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ। কারণ, কোনো ব্যক্তি জেনার পর তওবা করলে আল্লাহ ক্ষমা করেন। কিন্তু গিবতকারীকে যার গিবত করা হয়েছে, তিনি মাফ না করলে আল্লাহ মাফ করবেন না।’ (মুসলিম)। হাদিস শরিফে বর্ণিত আছে, গিবতের কাফফারা হলো তুমি যার গিবত করেছ, তার জন্য মাগফিরাতের দোয়া করবে। তুমি এভাবে বলবে, ‘হে আল্লাহ! তুমি আমার ও তার গুনাহ মাফ করে দাও।’ (বায়হাকি)।

সংশোধনের জন্য বলতে চাইলে যার বিষয় শুধু তাকেই বলা যাবে, অন্যকে নয়। সমালোচনাকারীকে বিচারের দিনে নিজের নেক আমল দিয়ে এর বিনিময় পরিশোধ করতে হবে। যার সমালোচনা করেছে, তার গুনাহ নিয়ে সমালোচনাকারীকে জাহান্নামে যেতে হবে।

গীবত একটি জঘন্য গুনাহ
ইমাম নববী রহ. জবান থেকে নিঃসৃত গুনাহর আলোচনা শুরু করেছেন। প্রথমেই তিনি এমন একটি গুনাহের কথা আনলেন যা আমাদের মাঝে ব্যাপক। গুনাহটির নাম গীবত। এটি জঘন্যতম একটি মহামারি। যার অসভ্য গ্রাস থেকে আমাদের সমাজ মুক্ত নয়। আমাদের কোনো আলোচনা, কোনো মজলিস এই জঘন্য পাপ থেকে মুক্ত নয়। মহানবী  এব্যাপারে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। কোরআন মজিদে গীবত সম্পর্কে কঠোর শব্দ এসেছে। সম্ভবত এরূপ কোনো শব্দ অন্য কোনো গুনাহ সম্পর্কে উচ্চারিত হয় নি। কোরআন মজিদে ইরশাদ হয়েছে,

وَلَا يَغْتَب بَّعْضُكُم بَعْضًا ۚ أَيُحِبُّ أَحَدُكُمْ أَن يَأْكُلَ لَحْمَ أَخِيهِ مَيْتًا فَكَرِهْتُمُوهُ

‘তোমরা একে অপরের গীবত বা পরনিন্দা করো না। (কারণ একটি জঘন্য পাপ। আপন ভাইয়ের গোশত খাওয়ার মতোই জঘন্য গুনাহ।) তোমাদের কেউ কি আপন মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া পছন্দ করে? (নিশ্চয় তা পছন্দ করেনা; বরং ভাববে এত বিকৃত কথা!) সুতরাং তোমরা গীবতকেও ঘৃণা করো।’
আয়াতটির অন্তর্নিহিত তাৎপর্য নিয়ে ভাবুন। কত কুৎসিত কাজ এই গীবত। একে তো মানুষের গোশত খাওয়া, তার উপর আপন ভাইয়ের গোশত, তাও আবার মৃত–কতবড় জঘন্য ও ঘৃণ্য কাজ! অবর্ণনীয় মন্দ কাজ। অনুরূপভাবে গীবতও একটি ঘৃণ্য ও জঘন্য গুনাহের নাম।

গীবত কাকে বলে?
গীবত অর্থ পরনিন্দা। কারো অনুপস্থিতিতে তার দোষ-ত্রুটি আলোচনা করা। হতে পারে দোষটি তার মধ্যে আছে। কিন্তু এই আলোচিত দোষটির কথা শুনলে সে নির্ঘাত মনে ব্যথা পাবে। তাহলে এটাই গীবত। হাদীস শরীফে এক সাহাবীর কথা এসেছে, যিনি নবীজী -কে প্রশ্ন করেছিলেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! গীবত কাকে বলে?
নবীজি  উত্তরে বলেছিলেন, আপন ভাইয়ের আলোচনা তার পেছনে এমনভাবে করা যা তার নিকট পছন্দনীয় নয়। অর্থাৎ সে পরবর্তীতে যদি জানতে পারে তার সম্পর্কে অমুক মজলিসে এ আলোচনা হয়েছে তাহলে মনে কষ্ট পাবে। এটাই গীবত।
সাহাবী পুনরায় জিজ্ঞেস করলেন, আমি যে দোষ নিয়ে আলোচনা করেছি তা যদি সত্যি সত্যি আমার ভাইয়ের মাঝে থাকে?
নবীজি  উত্তর দিলেন, আসলেই যদি দোষ থাকে তাহলেই গীবত হবে। অন্যথায় তার বিরুদ্ধে মিথ্যাচার হবে। (আবু দাউদ, বাবলু গীবাত ৪৮৭৪)
লক্ষ্য করুন, আমাদের আলোচনা এবং সভা-সমিতির প্রতি একটু চোখ বুলিয়ে দেখুন। কত ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়েছে এই মহামারি! আমরা দিবানিশি এই জঘন্য পাপে আকণ্ঠ নিমজ্জিত থাকি। আল্লাহ আমাদেরকে হেদায়েত করুন। অনেকে গীবতকে বৈধতার পোশাক পরাতে চায়। বলে থাকে, আমি গীবত করছি না; বরং আমি কথাটি তার মুখের উপরও বলে দিতে পারব। সুতরাং এটা তার পেছনেও বলতে পারব। জেনে রাখুন, গীবত গীবতই। মুখের উপর বলতে পারা আর না পারার বিষয় এখানে বিবেচ্য নয়। কারো দোষ-ত্রুটি তার অনুপস্থিতিতে আলোচনা করলেই তার গীবত হবে। যা একটি কবিরা গুনাহ; মহাপাপ।

গীবত করাও কবীরা গুনাহ
মদ পান, ডাকাতি এবং ব্যভিচার যেমনিভাবে কবিরা গুনাহ, অনুরূপভাবে গীবতও কবীরা গুনাহ। কবিরা গুনা হওয়ার দিক থেকে কোনো পার্থক্য এগুলোর মাঝে নেই। অন্যান্য কবিরা গুনাহর মতোই গীবতও নিঃসন্দেহে একটি হারাম কাজ। যেহেতু এটি হুকুকুল ইবাদ বা বান্দার হকের সাথে সম্পর্কযুক্ত। হুকুকুল ইবাদ একটি স্পর্শকাতর বিষয়। যার সম্পর্কে ইসলামের বিধান হল, সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি মাফ না করা পর্যন্ত মাফ হবে না। অন্যান্য গুনাহ তাওবার মাধ্যমে মাফ হয়ে যায়। কিন্তু গীবতের বেলায় শুধু তাওবা যথেষ্ট নয়। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিও ক্ষমা করে দিতে হবে। এবার অনুধাবন করুন, গীবত করা কত বড় গুনাহ। আল্লাহর ওয়াস্তে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হোন যে, কারো গীবত করবো না, কারো গীবত শুনবো না। কোনো মজলিসে গীবত শুরু হলে আলোচনার মোড় ঘুরিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। অন্য প্রসঙ্গে আলোচনা শুরু করে দেব। আলোচনার মোড় পাল্টাতে না পারলে মজলিস ছেড়ে চলে যাব। যেহেতু গীবত করাও হারাম এবং শোনাও হারাম।

গীবতকারী নিজের মুখমণ্ডল খামচাবে

عَنْ أَنَسِ بْنِ مَالِكٍ، قَالَ قَالَ رَسُولُ اللَّهِ صلى الله عليه وسلم ‏ ‏ لَمَّا عُرِجَ بِي مَرَرْتُ بِقَوْمٍ لَهُمْ أَظْفَارٌ مِنْ نُحَاسٍ يَخْمِشُونَ وُجُوهَهُمْ وَصُدُورَهُمْ فَقُلْتُ مَنْ هَؤُلاَءِ يَا جِبْرِيلُ قَالَ هَؤُلاَءِ الَّذِينَ يَأْكُلُونَ لُحُومَ النَّاسِ وَيَقَعُونَ فِي أَعْرَاضِهِمْ

সাহাবী হযরত আনাস ইবনে মালিক রাযি. নবীজি -এর বিশিষ্ট খাদেম। সুদীর্ঘ দশ বছর নবীজির খেদমত করেছেন। তিনি বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ  বলেছেন, মিরাজ-রজনীতে যখন আমাকে ঊর্ধ্বজগতে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল, তখন (জাহান্নাম দেখানোর সময়) আমাকে এমন কিছু লোক দেখানো হয়েছিল, যারা নিজেদের নখরাঘাতে মুখমণ্ডল ও বক্ষদেশ থেকে রক্ত ঝরাচ্ছিল‌। আমি জিবরাইল আ.-কে জিজ্ঞেস করলাম, এরা কারা? জিবরাইল আ. বললেন, এরা ঐসব লোক যারা মানুষের গোশত খেতো অর্থাৎ গীবত করতো। আর মানুষের ইজ্জত-সম্ভ্রমে আঘাত হানত। (আবু দাউদ ৪৮৭৮)

ব্যভিচারের চেয়েও জঘন্য
নবীজি  গীবত নামক এ জঘন্যতম গুনাহর কথা সাহাবায়েকেরামের সন্মুখে বিভিন্নভাবে প্রকাশ করেছেন। এজন্য এই সুবাদে আলোচনা করতে গিয়ে একটি হাদিস সামনে রাখা প্রয়োজন, যেন এর ভয়াবহতা ও কদর্যতা আমাদের হৃদয়ে বসে যায়। আল্লাহ তাআলা আপন রহমতে গুনাহটির ভয়াবহতা আমাদের অন্তরে বসিয়ে দিন এবং জঘন্য গুনাহটি থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দিন। আমিন।
উল্লেখিত হাদীসের মাধ্যমে গীবতের ভয়াবহতা আপনারা নিশ্চয় অনুধাবন করেছেন যে, গীবতকারী আখেরাতে নিজের মুখমণ্ডল খামচাবে।
অপর এক হাদীসে এসেছে, হাদীসটি সনদের দিক থেকে তেমন মজবুত না হলেও অর্থের দিক থেকে বিশুদ্ধ। রসুলুল্লাহ  বলেছেন, গীবতের গুনাহ জিনা-ব্যভিচারের গুনাহর চেয়েও মারাত্মক।
প্রশ্ন হল, এর কারণ কী?
উত্তর হল, আল্লাহ না করুন, যদি কেউ ব্যভিচারের গুনাহে লিপ্ত হয়ে যায় তাহলে পরবর্তীতে অনুতপ্ত হয়ে তওবা করে নিলে আল্লাহ চাহে তো গুনাহটি মাফ হয়ে যাবে। পক্ষান্তরে গীবত এমন মারাত্মক গুনাহ যে, গুনাহটির ক্ষমা ততক্ষণ পর্যন্ত পাওয়া যাবে না, যতক্ষণ না যার গীবত করেছে সে ক্ষমা করে দেয়। (মাজমাউজ জাওয়ায়েদ, বাবুল গীবাত খন্ড ৮ পৃষ্ঠা ৯২)

গীবতকারীকে জান্নাতে প্রবেশে বাধা দেওয়া হবে
নবীজি  অন্যত্র বলেছেন, গীবতের গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তি দুনিয়ায় বাহ্যিক দৃষ্টিতে নেককার হবে। নামাজ পড়বে, রোজা রাখবে, অন্যান্য ইবাদতও করবে। কিন্তু পুলসিরাত পার হওয়ার সময় তারা বাধাগ্রস্থ হবে।
পুলসিরাতের কথা আপনারা নিশ্চয় শুনেছেন। জাহান্নামের উপর অবস্থিত পুলের নাম পুলসিরাত। আখেরাতে সকলকেই ওই পুল পাড়ি দিতে হবে। জান্নাতি হলে পুলসিরাত সহজেই জয় করে নিবে। আর জাহান্নামী হলে তাকে টেনে জাহান্নামে ফেলে দেওয়া হবে। আল্লাহ আমাদেরকে রক্ষা করুন। গীবতকারীও এরূপ পরিস্থিতির শিকার হবে। তাদেরকে পুলসিরাত পাড়ি দেয়া থেকে বাধা প্রদান করা হবে। বলা হবে, তোমরা পুলসিরাত পাড়ি দিতে পারবে না। পাড়ি দিতে হলে গীবতের কাফফারা আদায় করে যাও। তারপর পাড়ি দাও। গীবতের কাফফারা মানে যাদের গীবত করা হয়েছে, তাদের থেকে ক্ষমা চেয়ে নেওয়া। তারা ক্ষমা করলে পুলসিরাত পার হতে পারবে, অন্যথায় নয়।

জঘন্যতম সুদ
এমনকি এক হাদীসে নবী  বলেছেন, সুদ একটি মহাপাপ। অসংখ্য গুনাহের সমষ্টি এটি। আল্লাহ আমাদের রক্ষা করুন। সুদের সবচেয়ে ছোট অপরাধ আপন মায়ের সাথে ব্যভিচার করার মত। লক্ষ্য করুন, সুদ সম্পর্কে এরূপ কঠোর বাণী উচ্চারিত হয়েছে, অন্য কোন গুনাহের কথা এত কঠোরভাবে বলা হয় নি। নবীজী  বলেন, সেই সুদের মত থেকে সবচাইতে জঘন্য শুধু হলো, অপর মুসলিম ভাইয়ের মানসন্মানকে আহত করা। অর্থাৎ গীবত করা। (আবু দাউদ, বাবুল গীবাত ৪৮৭৬)

মৃত ভাইয়ের গোশত খাওয়া
নবীযুগের দু’জন মহিলার কথা হাদীস শরীফে এসেছে। তারা রোজা রেখেছিল। রোজা অবস্থায় পরস্পরে গল্পগুজবে লিপ্ত হলো। এক পর্যায়ে অন্যের গীবতও শুরু করে দিল। ইত্যবসরে এক ব্যক্তি নবীজির দরবারে এসে আরজ করল, হে আল্লাহর রাসূল! দুইজন মহিলা রোজা রেখেছিল। তাদের অবস্থা এখন নিতান্ত নাজুক। পিপাসায় তাদের কলজে ফেটে যাচ্ছে। হয়তো তারা মারাই যাবে। রাসূলুল্লাহ  সম্ভবত ওহীর মাধ্যমে আগেই জেনেছিলেন যে, মহিলা দু’জন এতক্ষণ পর্যন্ত গীবতে লিপ্ত ছিল। তিনি বললেন, তাদেরকে আমার নিকট নিয়ে আসো। কথামতো তাদেরকে নবীজির খেদমতে হাজির করা হলো। নবীজি লক্ষ্য করে দেখলেন, সত্যি সত্যি তারা মৃতপ্রায়।
নবীজী  বললেন, একটি বড় পাত্র নিয়ে আসো। পাত্র আনা হলো। নবীজি  দু’জন মহিলা থেকে একজনকে নির্দেশ দিলেন, পাত্রটিতে বমি করো। মহিলা যখন বমি করা শুরু করল, দেখা গেল, এক অবাক কান্ড! বমির সঙ্গে রক্ত-পুঁজ ও গোশত উগলে পড়ছিল। তারপর দ্বিতীয় মহিলাকেও তিনি একই আদেশ করলেন। দেখা গেল, সেও রক্ত-পুঁজ ও দুর্গন্ধযুক্ত গোশত বমি করছে। এক পর্যায়ে সম্পূর্ণ পাত্র ভরে গেল। নবীজি উভয় মহিলাকে লক্ষ্য করে বললেন, এগুলো তোমাদের ভাই,-বোনের রক্ত-পুঁজ ও গোশত। রোজা অবস্থায় তোমরা এগুলো খেয়েছিলে। অর্থাৎ তাদের গীবত করেছিলে। রোজা রাখার কারণে তো তোমরা বৈধ খাবারও পরিহার করেছিলে। অথচ হারাম খাবার তথা গীবতের মাধ্যমে অপর ভাইয়ের রক্ত, পু্ঁজ ও গোশত ভক্ষণ তোমরা পরিহার করতে পারো নি। এগুলো খেয়ে তোমাদের পেট ভরে গিয়েছিল। ফলে তোমরা আজ এ দুরাবস্থার শিকার হয়েছিলে। যাও, ভবিষ্যতে কখনো আর গীবত করো না।
উক্ত ঘটনা আমাদের জন্য নিশ্চয়ই শিক্ষাপ্রদ। গীবতের রূপক নমুনাও আল্লাহ মানুষকে দেখালেন। গীবতের পরিণাম কত বীভৎস! কত ভয়াবহ!

একটি ভয়ঙ্কর স্বপ্ন
বিখ্যাত তাবেয়ী হযরত রাবঈ রহ. নিজের ঘটনা বর্ণনা করেন। তিনি বলেন, এক মজলিসে গিয়ে দেখতে পেলাম, লোকজন খোশগল্প করছে। আমিও তাদের সাথে বসে পড়লাম। গল্প জমে উঠলো। গীবতও শুরু হল। বিষয়টা আমার কাছে ভাল লাগে নি। তাই আমি উঠে গেলাম। কারণ ইসলামের বিধান হল, মজলিসে গীবত চললে পারলে বাধা দিবে। না পারলে মজলিস ত্যাগ করে উঠে চলে যাবে। আমি উঠে চলে গেলাম। কিছুক্ষণ পর ভাবলাম, এতক্ষণে হয়তো গীবত শেষ হয়ে গিয়েছে। কারো দোষচর্চা আর চলছে না। সুতরাং আলোচনায় পুনরায় শরিক হওয়া যায়। এই ভেবে আমি পুনরায় মজলিসে গিয়ে বসলাম। কিছু সময় এটা সেটা আলোচনা চলল। তারপরেই শুরু হলো গীবত। আমিও মজা পেয়ে গেলাম। আগ্রহের সঙ্গে তাদের গীবত শুনতে লাগলাম। একপর্যায়ে নিজেকে সামলে রাখতে পারলাম না। দু’চারটে গীবত নিজেও করে ফেললাম। মজলিস শেষে বাড়িতে ফিরে আসলাম। রাতে ঘুমের মধ্যে এক ভয়ঙ্কর স্বপ্ন দেখলাম। এক বীভৎস কালো লোক আমার জন্য পাত্রে করে গোশত নিয়ে এসেছে। লক্ষ্য করে দেখলাম, শূকরের গোশত।। লোকটি বলল, এটা শূকরের গোশত, খাও। আমি বললাম, কিভাবে খাবো, আমি তো মুসলমান? লোকটি বলল, না, ওসব আমি শুনবো না। তোমাকে খেতেই হবে। এই বলে লোকটা জোর করে আমার মুখে গোশত পুরে দেওয়া শুরু করলো। আমি তার কবল থেকে নিজেকে বাঁচানোর শত চেষ্টা করেও ব্যর্থ হলাম। বমি করতে চাইলাম তবুও রক্ষা পেলাম না। সে আমার উপর এক নির্মম অত্যাচার করেই যাচ্ছিল। সে কি কষ্ট! এরই মধ্যে আমার চোখ খুলে গেল। তারপর থেকে আমি যখনই আহার করার জন্য বসতাম, ঘটনাটি মনে পড়ে যেত। কেমন যেন স্বপ্নের সেই শূকরের গোশতের দুর্গন্ধ আমার নাকে লাগতো। কি অবস্থা ত্রিশ দিন পর্যন্ত ছিল। খাবার গ্রহণে আমার খুব কষ্ট হতো।
এই ঘটনা দ্বারা আল্লাহ আমাকে সতর্ক করলেন। কেবল একটি মজলিসের দু-চারটি গীবত এত ভয়ঙ্কর। দীর্ঘ ত্রিশ দিন পর্যন্ত আমি এই ভয়াবহতার গন্ধ পেয়েছি।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে গীবত করা ও শোনা থেকে হেফাজত করুন। আমিন।

হারাম খাদ্যের কলুষতা
আসলে পরিবেশ দূষিত হয়ে গেছে, ফলে আমাদের বোধশক্তিও নষ্ট হয়ে গেছে। তাই পাপকে এখন আর পাপ মনে হয় না।
হযরত মাওলানা ইয়াকুব নানুতবী রহ. বলেন, একবার একটি দাওয়াতের সন্দেহযুক্ত কিছু খাবার খেয়ে ফেলেছিলাম। সুদীর্ঘ কয়েক মাস পর্যন্ত এর কলুষতা আমার অন্তরে অনুভূত হয়েছে। ক্যানন চা খেয়েছিলাম তা হালাল কিনা; সন্দেহ ছিল। তারপর থেকে বারবার অন্তরে খারাপ চিন্তা আসতো। গুনাহ করার ইচ্ছা জাগতো। গুনাহের প্রতি আকর্ষণ অনুভব হত।
গুনাহের ফলে এটি। গুনাহ গুনাহকে টানে। প্রতিটি গুনাহ অন্তরকে কদর্য ও তমসাচ্ছন্ন করে তোলে। ফলে গুনাহর প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি হয়। পাপ কাজে ব্রতী হয়।
আল্লাহ তাআলা আমাদের অনুভূতিকে সুস্থ করে দিন। আমিন।
মোটকথা গীবত খুবই মারাত্মক গুনাহ। আল্লাহ যাকে সুস্থ বিবেক দিয়েছেন, সেই অনুধাবন করতে পারে যে, কত বড় গুনাহতে আমি লিপ্ত।

যেসব ক্ষেত্রে গীবত জায়েজ
গীবত-এর সংজ্ঞা তো আপনাদের অজানা নয়। কারো অনুপস্থিতিতে দোষচর্চা করা। বাস্তবে দোষ থাকুক বা না থাকুক সে শুনলে মনে কষ্ট পাবে। এটাই তো গীবত-এর সংজ্ঞা। এই সুবাদে আমাদের ভালো করে বুঝতে হবে যে, ইসলাম প্রকৃতির ধর্ম। প্রতিটি জিনিসের স্বভাব বা প্রকৃতির প্রতি লক্ষ্য রেখেই ইসলাম বিধান প্রণয়ন করেছে। মানুষের স্বভাব ও চাহিদার প্রতিও ইসলাম লক্ষ রেখেছে। তদনুযায়ী বিধান প্রদান করেছে। এরই নিমিত্তে ইসলাম কয়েকটি বিষয়কে গীবতের আওতামুক্ত রেখেছে। বিষয়গুলো বাহ্যিক দৃষ্টিতে গীবত মনে হবে। অথচ ইসলামের দৃষ্টিতে এগুলো গীবত নয়।

কারো অনিষ্টতা থেকে বাঁচানোর লক্ষ্যে গীবত করা যাবে
যেমন কেউ এমন কাজ করছে, যার দ্বারা অন্য লোকের ক্ষতি হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে, তাহলে এটা ষড়যন্ত্র। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে এ সম্পর্কে অবহিত না করলে সে ষড়যন্ত্রের শিকার হবে। তাই তাকে এটা বলে দেওয়া জায়েজ হবে যে, তুমি সতর্ক থেকো, তোমার বিরুদ্ধে অমুক এই ষড়যন্ত্র পাকাচ্ছে। এটাই নবীজি -র শিক্ষা। তিনি আমাদেরকে সবকিছু শিক্ষা দিয়ে তারপর বিদায় নিয়েছেন।
হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, একদিনের ঘটনা। আমি নবীজির খেদমতে বসা ছিলাম। ইত্যবসরে দেখলাম, সামনের দিক থেকে এক লোক আমাদের দিকে এগিয়ে আসছে। রাস্তায় থাকাকালীন নবীজি  তার দিকে ইঙ্গিত করে আমাকে বললেন, লোকটি তার গোত্রের নিকৃষ্ট ব্যক্তি। হযরত আয়েশা রাযি. বলেন, একথা শুনে আমি একটু সতর্ক হয়ে বসলাম। কারণ দুষ্ট লোকের থেকে সতর্ক থাকা উচিত। তারপর লোকটি যখন মজলিসে এসে বসল, নবীজি  তার সাথে স্বভাব অনুযায়ী সদাচরণ করলেন। লোকটি চলে যাওয়ার পর হযরত আয়েশা রাযি. নবীজিকে জিজ্ঞেস করলেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আপনার ভাষ্যমতে লোকটি গোত্রের নিকৃষ্ট ব্যক্তি। অথচ সে আপনার মজলিসে বসল আর আপনি তার সঙ্গে এত সুন্দর ব্যবহার করলেন; এর কারণ কী? নবীজি  উত্তর দিলেন, দেখো, লোকটি আসলেই ভয়ঙ্কর। সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করা তার স্বভাব। মানুষ তার থেকে পালিয়ে বাঁচে। তার সঙ্গে যদি সুন্দর ব্যবহার করা না হয়, তাহলে এসে ত্রাস ও অরাজকতা সৃষ্টি করতে পারে। তাই আমি তার সঙ্গে অভ্যাসমাফিক সুন্দর ব্যবহার করলাম। (তিরমিজি শরিফ ১৯৯৬)
হাদীসটির ব্যাখ্যায় ওলামায়েকেরাম লিখেছেন, রাসূলুল্লাহ  আয়েশাকে যে বললেন, ‘লোকটি গোত্রের নিকৃষ্ট ব্যক্তি।’ সাধারণ দৃষ্টিতে এটা গীবত হয়েছে। যেহেতু মন্তব্যটি তার অনুপস্থিতিতে হয়েছে। তবু এটা জায়েজ। কারণ এর দ্বারা নবীজির উদ্দেশ্য ছিল, লোকটির অনিষ্টতা থেকে আয়েশা রাযি.-কে সতর্ক করা। যেন আয়েশা রাযি. লোকটির কোনো ফ্যাসাদের শিকার না হন। সুতরাং হাদীসটি থেকে আমরা বুঝতে পারলাম, কাউকে অন্যের ষড়যন্ত্র অত্যাচার থেকে বাঁচানোর জন্য গীবত করা যাবে। এটা জায়েজ। বরং এজাতীয় গীবত গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়।

যদি কারো প্রাণনাশের আশঙ্কা হয়
অবস্থাবিশেষে অপরের দোষ বর্ণনা করার প্রয়োজন পড়তে পারে। যেমন আপনি দেখলেন, একজন আরেকজনকে খুন বা আক্রমণ করার প্রস্তুতি নিচ্ছে। এই অবস্থায় আপনি চোখ বুজে থাকতে পারবেন না। বরং সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে বলে দিতে হবে যে, তোমার জীবন হুমকির সম্মুখীন। এতে সে নিজেকে বাঁচানোর সুযোগ পাবে। এই বিশেষ ক্ষেত্রে গীবত করা আপনার জন্য বৈধ হবে।

প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির গীবত
এক হাদীসে আছে, যার সঠিক অর্থ অনেকে উদ্ধার করতে পারেনা। হাদীসটি হল, রাসুলুল্লাহ ﷺ বলেছেন,

لَا غِيبَةَ لِفَاسِقِ ولا مجاهر

অর্থাৎ, ফাসিক ও প্রকাশ্যে গুনাহকারী ব্যক্তির গীবত করলে তা গীবত হিসাবে বিবেচিত হবে না। (জামেউল উসূল, খন্ড ০৮ পৃষ্ঠা ৪৫০)
হাদীসটির অর্থ অনেকে উল্টোভাবে করে। তাদের ধারণা, কবীরা গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির অথবা বেদআতে অভ্যস্ত ব্যক্তির গীবত যেভাবে ইচ্ছা সেভাবে করা যাবে। এতে কোন গোনাহ নেই। এটা জায়েজ। মূলত হাদীসটির অর্থ এটা নয়। বরং হাদীসটির মর্মার্থ হল, প্রকাশ্যে গুনাহে লিপ্ত ব্যক্তির গীবত করা যাবে। যেমন মদ্যপ। প্রকাশ্যে মদপান যার জন্য নিতান্ত মামুলী ব্যাপার। এরকম ব্যক্তির পেছনে কেউ যদি বলে, অমুক মদপান করে; তাহলে এটা গীবত হবে না। কারণ সে তো প্রকাশ্যে মদ পান করে। এর মাধ্যমে কেমন যেন সে ঘোষণা করে বেড়াচ্ছে যে, আমি মদ পান করি। সুতরাং তার অনুপস্থিতিতে কথাটি আলোচনা করলে তার মনে কষ্ট যাওয়াটা বিবেচ্য বিষয় নয়। বিধায় এটা গীবত হবে না।

এটাও গীবত
কিন্তু যে সব দোষ উক্ত ব্যক্তি গোপন রাখতে চায় সে সব দোষ নিয়ে যদি আপনি তার অনুপস্থিতিতেই ঘাটাঘাটি করেন তাহলে তা গীবত হবে। যেমন সে প্রকাশ্যে মদ খায় ঠিক তবে তার এমন আরও একটি গুনাহও আছে, যা সে প্রকাশ্যে করে না। গোপনে করে। সে মানুষের সামনে তার এই গুনাহটি প্রকাশ করতে রাজি নয়। গুনাহটিও এমন যে, এর কারণে অন্যদের ক্ষতি হয় না। এরূপ ক্ষেত্রে তার উক্ত গুনাহের কথা আলোচনা করা জায়েজ হবে না; বরং এটা তখন গীবত হবে ।
বোঝা গেল, প্রকাশ্যে যে গুনাহটি মানুষ করে তার আলোচনা করা গীবত নয়। পক্ষান্তরে যে সব গুনাহ মানুষ গোপনে করে সেগুলোর আলোচনায় অপরের সামনে করা গীবতের শামিল। উপরোক্ত হাদীসের মর্মার্থও এটা।

ফাসেক ও গুনাহগারের গীবতও নাজায়েজ
হযরত আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেছেন, এক মজলিসে হযরত ওমর রাযি.-এর পুত্র আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. উপস্থিত ছিলেন। ইতোমধ্যে মজলিসের এক লোক হাজ্জাজ বিন ইউসুফের সমালোচনা শুরু করে দিল। আব্দুল্লাহ ইবনে ওমর রাযি. তাকে বাধা দিয়ে বললেন, দেখো তোমার এই সমালোচনা গীবতের অন্তর্ভুক্ত। তুমি মনে করো না, হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ শত শত লোকের হত্যাকারী তাই তার গীবত হালাল হয়ে গিয়েছে। ভালোভাবে জেনে নাও, তার গীবত করা হালাল হয়নি। বরং আল্লাহ তাআলা হাজ্জাজ-বিন-ইউসুফ থেকে শত শত মানুষের রক্তের হিসাব যেমনিভাবে নিবেন, অনুরূপভাবে তুমি যে তার পেছনে গীবত করেছ তার হিসাবও নিবেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের হেফাজত করুন। আমিন।
সুতরাং ফাসেক, পাপী অথবা বেদআতী হলেই তার গীবত করা চলবে না। এই চিন্তা নিতান্তই ভ্রান্ত। এজাতীয় লোকের গীবত করা থেকেও বেঁচে থাকা ওয়াজিব।

জালিমের জুলুমের আলোচনা গীবত নয়
আরেকটি ক্ষেত্রে ইসলাম গীবতের অনুমতি দিয়েছে। তা হল, এক ব্যক্তি তোমার উপরে জুলুম করেছে। এই জুলুমের কথা তুমি অপরকে শোনাতে পারবে। বলতে পারবে আমার সাথে এ অন্যায় করা হয়েছে, এ জুলুম করা হয়েছে। এটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত হবে না। গুনাহও হবে না। যাকে তুমি জুলুমের কাহিনী শুনিয়েছে সে এর প্রতিকার করতে সক্ষম হোক বা না হোক; শোনাতে পারবে । যথা কোন ব্যক্তি তোমার মাল চুরি করেছে। থানায় গিয়ে তুমি তার বিরুদ্ধে চুরির মামলা দায়ের করলে তাহলে যদিও এটা তার অনুপস্থিতিতে তার দোষ চর্চা হয়েছে কিন্তু এটা গীবত হবে না। কারন সে তোমার ক্ষতি করেছে তারপর তুমি থানায় গিয়ে বিচারপ্রার্থী হয়েছ। থানা কর্তৃপক্ষ এর বিচার করবেন। সুতরাং এটা গীবতের অন্তর্ভুক্ত নয়।
অনুরূপভাবে চুরির ঘটনা যদি এমন লোকের নিকট বলা হয়, যে এর প্রতিকার করতে সক্ষম নয়। যেমন চুরির খবর শুনে কিছু লোক তোমার বাড়ি চলে আসলো। তুমি জানো যে, তোমার বাড়িতে কে চুরি করেছে। তাই তুমি তাদের নিকট বলে দিলে যে, আজ রাত অমুক আমার বাড়িতে চুরি করেছে। কিংবা বললে, অমুক আমার ক্ষতি করেছে। কিংবা বললে, অমুক আমার উপর এ জুলুম করেছে। তাহলে এটা গুনাহ হবে না। যেহেতু এটা গীবত নয়।
লক্ষ্য করুন, ইসলাম মানবপ্রকৃতিকে কতটুকু গুরুত্ব দিয়েছে। মানুষের স্বভাবপ্রকৃতি হল, দুর্দশাগ্রস্ত হলে সে অন্যের নিকট প্রকাশ করতে চায়। নিজের দুঃখের কথা অন্যকে বলে মনের বোঝা কিছুটা হালকা করতে চায়। তখন সেই খেয়াল করে না যে, অপর কেউ তার দুঃখ লাঘব করতে পারবে কিনা! ইসলাম এই মানবীয় মেজাজের প্রতি লক্ষ্য রেখেছে । অন্যের নিকট দুঃখ ব্যক্ত করার অনুমতি দিয়েছে। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,

لَّا يُحِبُّ اللَّهُ الْجَهْرَ بِالسُّوءِ مِنَ الْقَوْلِ إِلَّا مَن ظُلِمَ ۚ

আল্লাহ তাআলা মন্দবিষয় প্রকাশ করা পছন্দ করেন না। অবশ্য যার উপর জুলুম করা হয়েছে, তার কথা আলাদা।
অর্থাৎ, তার উপর যে অত্যাচার করা হয়েছে সেটা সে অপরের নিকট বলতে পারবে। এটা গীবত নয়; বরং জায়েজ।
মোটকথা উল্লেখিত কয়েকটি বিষয় আল্লাহ তাআলা গীবতের আওতামুক্ত রেখেছেন। এগুলো গীবতের শামিল হবে না। এগুলো ব্যতীত আমরা যে মজলিসে বসলেই সমালোচনার ঝুলি খুলে দেই, সে সবই গীবত। সুতরাং গীবতের মহামারি থেকে বেঁচে থাকুন। আল্লাহর ওয়াস্তে নিজের উপর দয়া করুন। জবানকে হেফাজত করুন।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে জবান সংযত রাখার তৌফিক দিন। আমিন।

গীবত থেকে বাঁচার শপথ
গীবতের বিস্তৃত আলোচনা আপনাদের সামনে উপস্থাপন করা হল। আপনারা এতক্ষণ তা শুনেছেন। কিন্তু এক কান দিয়ে শুনে অপর কান দিয়ে বের করে দিলে চলবে না। প্রতিজ্ঞা নিতে হবে যে, ইনশাআল্লাহ, আর কোনদিনও কারো গীবত বা পরনিন্দাসুচক একটি শব্দও বলব না। তবুও কখনো ভুল হয়ে গেলে সঙ্গে সঙ্গে তওবা করে নিতে হবে। গীবতের সঠিক প্রতিকার বা চিকিৎসা হলো, যার গীবত করা হয়েছে তার নিকট সরাসরি ক্ষমা প্রার্থনা করা। একথা বলা যে, ‘ভাই, আমি তোমার গীবত করেছি, আমাকে মাফ করে দাও।’ আল্লাহ তাআলার কিছু বিশেষ বান্দা আছেন তারা এমনই করে থাকেন।

বাঁচার উপায়
হযরত থানবী রহ. বলেছেন, মাঝে মাঝে দু’এক ব্যক্তি আমার কাছে এসে বলেন যে, হুজুর, আমি আপনার গীবত করেছি। আমাকে মাফ করে দিন।
তখন আমি তাদেরকে বলি, এক শর্তে মাফ করে দিব। প্রথমে বলতে হবে, আমার কী গীবত করেছ? এর দ্বারা আমার উদ্দেশ্য হলো, যাতে আমি জানতে পারি, মানুষ আমার সম্পর্কে কী বলে! যদি আমার সামনে বলতে পারো তাহলে মাফ পেয়ে যাবে।
হযরত থানবী বলেন, আমার এরূপ করার পেছনে একটা কারণ আছে। তা হল, হতে পারে, যে দোষ আলোচনা করা হয়েছে, তা আমার মধ্যে বাস্তবেই আছে। সুতরাং দোষটা আমার জানা হয়ে যাবে এবং এর মাধ্যমে হয়তো আল্লাহ তাআলা এ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক আমাকে দিয়ে দিবেন।
তাই গীবতের প্রকৃত চিকিৎসা এটাই। এ চিকিৎসা গ্রহণ করা যদিও কষ্টকর, যদিও মনের উপর করাত চালিয়ে তারপর অন্যকে বলতে হবে,’আমাকে মাফ করে দাও, আমি তোমার গীবত করেছি।’ তবুও এটাই আসল চিকিৎসা। দু’চার বার এই তদবির মত কাজ করলে ইনশাআল্লাহ ভবিষ্যতের জন্য শিক্ষা হয়ে যাবে।
বুযুর্গানে দ্বীন অবশ্য গীবত থেকে বাঁচার জন্য অন্যান্য ব্যবস্থাপত্রও দিয়েছেন। যেমন হযরত হাসান বসরী রহ. বলেছেন, যখন অন্যের দোষচর্চার কথা মনে পড়বে তখনই নিজের দোষগুলোর কথা চিন্তা করবে। ভাববে, কোনো মানুষই তো দোষমুক্ত নয়। আমার মধ্যেও তো এই দোষ আছে, ওই দোষ আছে… । সুতরাং অন্যের দোষচর্চা আমি কিভাবে করি! পাশাপাশি গীবতের শাস্তির কথা ও ভাববে। আল্লাহর নিকট দো’আ করবে যে, হে আল্লাহ! আমাকে এই ভয়াবহ শাস্তি থেকে রক্ষা করুন । মজলিসে দোষ চর্চা হতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে আল্লাহর কথা স্মরণ করবে। দোয়া করবি, হে আল্লাহ! এই মজলিসে গীবত শুরু হয়ে গিয়েছে; আমাকে হেফাজত করুন। এই জঘন্য পাপ থেকে আমাকে রক্ষা করুন ।

গীবতের কাফফারা
এক হাদীসে এসেছে। হাদীসটি সনদের দিক থেকে দুর্বল হলেও অর্থের দিক থেকে বিশুদ্ধ। যদি ঘটনাচক্রে কারো গীবত হয়েই যায় তাহলে তার কাফফারা দিতে হবে। কাফফারা হলো, যার গীবত করা হয়েছে তার জন্য বেশি বেশি করে দোয়া করা, ইস্তেগফার করা। যেমন কেউ আজীবন গীবত করেছিল। এখন তার হুঁশ হলো। ভাবল, আমি তো আজীবন এগুনাহ করে এসেছি। কার কার গীবত করেছি তাও পুরোপুরি জানা নেই। কোথায় তাদেরকে খুঁজে বেড়াবো, তবে ভবিষ্যতে আর গীবত করবো না। এখন উপায়? উপায় একটাই। যাদের গীবত করা হয়েছে তাদের জন্য দোয়া করতে থাকা, ইস্তেগফার অব্যাহত রাখা। এভাবে হয়তো গুনাহটি থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে। (মিশকাত, কিতাবুল আদাব ৪৮৭৭)

কারো হক নষ্ট হলে
কারো হক নষ্ট হলে এ গুনাহ থেকে বাঁচার উপায় কী?
এসম্পর্কে হাকীমুল উম্মত আশরাফ আলী থানবী রহ. এবং আমার শ্রদ্ধেয় পিতা মুফতি মুহাম্মদ শফী রহ.-এর চিঠি প্রণিধানযোগ্য। চিঠিতে লেখা ছিল,’জীবনে আপনার বহু হক নষ্ট করেছি। কত অন্যায় আপনার সঙ্গে করেছি। সামগ্রিকভাবে আমার এ অসংখ্য অন্যায় ও অপরাধের ক্ষমা চাচ্ছি। আল্লাহর ওয়াস্তে আমাকে ক্ষমা করে দিন।’
এজাতীয় চিঠি তাঁদের সম্পর্কের সকল লোকের নিকট পাঠিয়েছিলেন। আশা করা যায় আল্লাহ তাঁদেরকে মাফ করে দিয়েছেন। অপরের হক নষ্ট করার গুনাহ থেকে মুক্তি দান করেছেন।
পক্ষান্তরে যদি এমন লোকের হক নষ্ট করা হয় যার নিকট ক্ষমা চাওয়া সম্ভব নয়। কারণ হয়তো সে মারা গিয়েছে অথবা এমন কোথাও চলে গেছে যেখানের ঠিকানা জানা নেই এবং জানাও সম্ভব নয়। এরূপ পরিস্থিতির নিরসনে হযরত হাসান বসরী রহ. বলেছেন,
‘যার গীবত করেছ কিংবা হক মেরেছ তার জন্য বেশি বেশি দোয়া করতে থাকো। দোয়া করো, হে আল্লাহ আমি অমুকের গীবত করেছি, অমুকের হক নষ্ট করেছি; আপনি আমার উপর রহম করুন। আমার এ অন্যায় তাদের জন্য মর্যাদা বৃদ্ধির কারণ হিসাবে পরিণত করুন।’
সাথে সাথে তাদের জন্য অধিকহারে তওবা ও ইস্তেগফার করবে। এটাও গুনাহ ও শাস্তি থেকে বাঁচার একটি পন্থা।
আমরা যদি বুযুর্গদের মত চিঠি দেখি তাহলে আমাদের কি নাক কাটা যাবে? নাকি আমাদের মর্যাদাহানী হবে? হিম্মত করে যদি আমরা এরূপ করতে পারি, হতে পারে আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।

ক্ষমা চাওয়া ও ক্ষমা করার ফজিলত
হাদীস শরীফে এসেছে, যদি আল্লাহর কোনো বান্দা কারো নিকট ক্ষমা চায়, যার নিকট ক্ষমা চাওয়া হয়, সে যদি ক্ষমাপ্রার্থী করুণ ও লজ্জিত অবস্থা দেখে তাকে মাফ করে দেয় তাহলে আল্লাহ তাআলাও তাকে ঐদিন মাফ করে দিবেন যেদিন তাঁর ক্ষমা সবচেয়ে বেশি প্রয়োজন হবে। কিন্তু যদি মাফ না করে বলে দেয়, আমি তোমাকে মাফ করবো না। তাহলে আল্লাহ তা’আলা বলেন, আমিও সেদিন তোমাকে মাফ করবো না। তুমি যখন আমার বান্দাকে মাফ করছ না, আমি কিভাবে আজ তোমাকে মাফ করবো?
ব্যাপারটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই ক্ষমা চাইতে হবে। মাফ করুক বা না করুক তবুও ক্ষমা প্রার্থনা করতে হবে। ক্ষমা চাওয়াও একপ্রকার দায়মুক্তি। যার হক নষ্ট করা হয়েছে সর্বদা তার নিকট ক্ষমা চাইতে হবে। এটা হক নষ্টকারীর অনিবার্য কর্তব্য।

মহানবী এর ক্ষমা চাওয়া
আমার আর আপনার মূল্যই বা কতটুকু! নবীজি  মসজিদে নববীতে দাঁড়িয়ে সাহাবায়েকেরামের উদ্দেশ্যে বললেন, আজ আমি নিজেকে তোমাদের নিকট সপে দিচ্ছি। যদি আমার দ্বারা কেউ কষ্ট পেয়ে থাকো, আমি যদি কারো শারীরিক বা আর্থিক ক্ষতি করে থাকি তাহলে আজ আমি তোমাদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি, প্রতিশোধ নিতে চাইলে নিয়ে নাও। মাফ করতে চাইলে তাও করতে পারো। কিয়ামতের কঠিন মুহূর্তে যেন আমার জিম্মায় তোমাদের কোনো অধিকার অবশিষ্ট না থাকে।
এবার বলুন, সারা বিশ্বের রহমত, মানবজাতির মহান আদর্শ নবী মুহাম্মদ । সাহাবায়েকেরাম যাঁর ইশারার অপেক্ষায় থাকতেন। প্রয়োজনে জীবন বিলিয়ে দিতেও তারা সদাপ্রস্তুত থাকতেন। আজ তিনি নিজেই বলছেন, আমি যদি কারো উপর কোনো অন্যায় করে থাকি, যদি কারো হক নষ্ট করে থাকি তাহলে সে যেন প্রতিশোধ নিয়ে নেয়।
এক সাহাবী দাঁড়িয়ে গেলেন। বললেন, হে আল্লাহর রাসূল! একবার আপনি আমার কোমরে আঘাত করেছিলেন। আমি প্রতিশোধ নেব।
নবীজি  একটুও বিরক্ত হলেন না বরং বললেন, এসো, প্রতিশোধ নাও। তুমিও আমার কোমরে আঘাত কর।
সাহাবী এগিয়ে গেলেন। নবীজির পাশে দাঁড়ালেন। তারপর বললেন, ইয়া রাসূলাল্লাহ! আপনি যখন আঘাত করেছিলেন তখন আমার কোমর উন্মুক্ত ছিল। কোমরে তখন কোনো কাপড় ছিলনা। তাই পরিপূর্ণ প্রতিশোধ নিতে হলে আপনিও কাপড় উন্মুক্ত করুন।
নবীজি  তখন ছিলেন চাদরাবৃত। বললেন, ‘আমি চাদর তুলে ধরছি।’ এই বলে তিনি চাদর সরিয়ে নিলেন।
সাহাবীও সুযোগ কাজে লাগালেন। তিনি আবেগাপ্লুত হয়ে পড়লেন এবং মাথা ঝুঁকিয়ে নবীজির মাহরে নবুওয়াতকে চুমু দিলেন। তারপর বললেন, ইয়া রাসুলাল্লাহ! আমি গোস্তাখি করেছি। শুধু এজন্য গোস্তাখি করেছি। আমাকে মাফ করে দিন। ( মাজমাউজ জাওয়ায়েদ খন্ড ৯ পৃষ্ঠা ২৭)
নবীজি  নিজেকে এভাবে সাহাবায়েকেরামের সামনে পেশ করেছিলেন। ভেবে দেখুন, আমার আর আপনার স্থান কোথায়! তাই যদি আমরা নিজেদের সম্পর্কের লোকদের নিকট ক্ষমা প্রার্থনার চিঠি লিখি তাহলে আমাদের কী এমন অসুবিধা হবে! হতে পারে আল্লাহ এর ওসিলায় আমাদেরকে মাফ করে দিবেন।সুন্নতের অনুসরণের নিয়তে যখন আমরা কাজটি করব হতে পারে আল্লাহ আমাদেরকে ক্ষমা করে দিবেন।
আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

ইসলামের একটি মূলনীতি
ইসলামের একটি মূলনীতি নবীজি  বলে দিয়েছেন যে, ঈমানের দাবী হল, নিজের জন্য ওই জিনিস পছন্দ করবে যা অন্যের জন্য পছন্দ করবে। আর অপরের জন্যই জিনিস পছন্দ করবে যা নিজের জন্য করবে। অনুরূপভাবে নিজের জন্য তাই অপছন্দ করবে যাও পরের বেলায় অপছন্দ করো।
এবার বলুন,আপনার অনুপস্থিতিতে কেউ আপনার দোষ-ত্রুটি ঘাটাঘাটি করলে আপনার অন্তরে ব্যথা লাগবে কি? আপনি তাকে কী বলবেন__ভালো না খারাপ? যদি তাকে খারাপ ভাবেন,আপনার দোষ চর্চার কারণে যদি সে খারাপ হয়ে যায় তাহলে আপনি এই কাজটিই অপরের জন্য করবেন__তা কিভাবে ভালো হতে পারে! এটাতো দ্বৈতনীতি। নিজের জন্য এক নিয়ম অপরের জন্য আরেক নিয়ম। এরই নাম মুনাফেকি। গীবতের মধ্যে মুনাফিকি ও শামিল আছে। এ কথাগুলো গভীরভাবে চিন্তা করুন। গীবতের শাস্তির কথা ভাবুন। তাহলে ইনশাআল্লাহ গীবত করার উৎসাহ কমে যাবে।

গীবত থেকে বাঁচার সহজ পদ্ধতি
হাকীমুল উম্মত হযরত মাওলানা আশরাফ আলী থানবী রহ. বলেছেন, গীবত থেকে বেঁচে থাকার সহজ পদ্ধতি আছে। তা হল, অপরের আলোচনাই করবে না। ভালো কিংবা মন্দ সব আলোচনা থেকে নিজেকে বিরত রাখবে। কারণ শয়তান খুব ধূর্ত। যখন কারো প্রশংসা শুরু করবে এবং তার গুণ ও উত্তম অভ্যাসগুলো আলোচনা করবে তখন শয়তান তোমার বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হবে। কোন ফাঁকে তোমার মগজে ঢুকিয়ে দিবে যে, আমিতো শুধু প্রশংসাই করে যাচ্ছি। তার ওই দোষও তো আছে; ওটা বলি না কেন? তখন তোমার কথার ধরন পাল্টে যাবে। বলবে, অমুক ভালো তবে এই দোষটি তার মধ্যে আছে। এভাবে ‘তবে’ শব্দটিই তোমার সব শেষ করে দিবে। পুরো আলোচনাটা গীবতে পরিণত করে দিবে। তাই হাকীমুল উম্মত থানবী রহ. বলেন, যথাসম্ভব অপরের আলোচনা থেকে বিরত থাকবে। ভালো-মন্দ কোনো মন্তব্যের প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ, একান্ত যদি করতে হয় তাহলে ভালো আলোচনাই করার জন্য কোমর বেঁধে বসবে। সতর্ক থাকবে শয়তান যেন ভুল পথে নিয়ে না যায়।

নিজের দোষ দেখো
ভাই, অন্যের দোষ কেন দেখো! নিজের দোষ দেখো। নিজের কৃতকর্মের কথা স্মরণ কর। কারণ অপরের দোষের শাস্তি তোমাকে দেওয়া হবে না। তার দোষের শাস্তি সেই ভোগ করবে। তুমি পাবে তোমার সাজা। এটাই তোমার ফিকির হওয়া চাই। নিজের আমলের ব্যাপারে সজাগ থাকা চাই। অপরের দোষ তখনই চোখে লাগে যখন নিজের অন্যায় সম্পর্কে উদাসীন থাকে। নিজের দোষত্রুটি যখন সামনে থাকে তখন অন্যের দোষের দিকে ভুলেও চোখ যায় না। জবানে অন্যের দোষচর্চা আসে না।
আল্লাহ তাআলা আমাদের নিজের দোষ দেখার তৌফিক দান করুন। আমিন।
সমাজের সকল অনিষ্টের মূল একটাই_আমরা নিজের প্রতি নজর দেই না। ভুলে গেছি, আমার কবরে আমাকেই থাকতে হবে। আমরা এসব কথা সম্পূর্ণ ভুলে বসেছি। তাই কখনো এর গীবত করছি, কখনো ওর গীবত করছি। কখনো এর দোষচর্চা করছি, কখনো ওর দোষচর্চা করছি। মোটকথা দিনরাত আমরা এ জঘন্য গুনাহে লিপ্ত আছি। আল্লাহর ওয়াস্তে এ গুনাহ থেকে মুক্তি লাভের চেষ্টা করুন।

আলোচনার মোড় পাল্টে দাও
আমাদের সমাজ ও পরিবেশ বড়ই নাজুক। এ সমাজে গীবত থেকে বেঁচে থাকা আসলেই কষ্টকর। তবে সাধ্যের বাইরে নয়। কারণ সাধ্যের বাইরে হলে আল্লাহ তাআলা গীবত হারাম করতেন না। দ্বারা প্রতীয়মান হয়, গীবত থেকে বেঁচে থাকার শক্তি মানুষের আছে। সুতরাং আলোচনা যখন গীবতের পথে এগোবে তখন সঙ্গে সঙ্গে সেখান থেকে ফিরে আসবে। গীবত ছাড়া অন্য আলোচনা করবে। এরপরেও যদি গীবত হয়ে যায় সঙ্গে সঙ্গে তওবা করবে, ইস্তেগফার করবে। ভবিষ্যতে গিবত না করার শপথ নিবে।

গীবত সকল অনিষ্টের মূল
মনে রাখবেন, গীবত সকল অনিষ্টের মূল। ঝগড়া-ফ্যাসাদ এ গীবতের কারণেই হয়। পরস্পর অনৈক্যের মূলও এটি। বর্তমান সমাজে যেসব বিশৃঙ্খলা দেখতে পাচ্ছি, এর জন্যও গীবত অনেকাংশে দায়ী। আল্লাহ না করুন, কেউ যদি মদ পান করে তাহলে সকলেই তাকে খারাপ ভাববে। দীনের সঙ্গে সামান্যতম সম্পর্ক আছে, এমন ব্যক্তিও তাকে ‘মন্দ’ ভাববে। সকলেই বলবে, এ তো পাপাচারে লিপ্ত। স্বয়ং মদপানকারীও নিজেকে ‘ভালো’ মনে করবে না। অদৃশ্য এক পাপ-যাতনায় সে সর্বদাই লিপ্ত থাকবে। পক্ষান্তরে গীবতকারীর অন্তরে এরূপ কোন অনুভূতি জাগে না। কেউ তাকে খারাপ মনে করে না।  সুতরাং বুঝা গেল, গীবত যে কত বড় গুনাহ তা আমাদের অন্তরে এখনো আলোড়ন সৃষ্টি করে নি। জঘন্য, মারাত্মক ও অপবিত্র একটি কাজে আমরা লিপ্ত আছি; একথা আমরা আজও অনুধাবন করতে পারি নি। এর পরিণতির কথা আমরা একটুও ভাবি না। গীবতের হাকিকত সম্পর্কেও আমরা সম্পূর্ণ উদাসীন। অথচ মদ পান করার গুনাহ আর গীবতের গুনাহর মধ্যে কোনো তফাৎ নেই। মদ পান করা যেমন অন্যায় ও অপরাধ, অনুরূপভাবে গীবত করাও একটা অপরাধ। সুতরাং অন্তরে গীবতের মারাত্মক পরিণতি ও জঘন্য শাস্তির ভয় সৃষ্টি করতে হবে।

ইশারার মাধ্যমে গীবত করা
উম্মুল মু’মিনীন হযরত আয়েশা রাযি. নবীজি -এর নিকট বসে আলোচনা করছিলেন। কথায় কথায় উম্মুল মু’মিনীন হযরত সাফিয়্যা রাযি.-এর কথা উঠলো। সতীনদের মাঝে পারস্পরিক একটু টানাপড়েন থাকা যেহেতু অস্বাভাবিক নয় আর হযরত আয়েশা রাযি.-ও এ থেকে মুক্ত ছিলেন না। তাই তিনি হযরত সাফিয়া রাযি.-এর কথা আলোচনা করতে গিয়ে বিশেষ ভঙ্গিতে ইশারা করলেন। এর দ্বারা হযরত আয়েশা রাযি. ইঙ্গিতে বোঝাতে চেয়েছেন যে, তিনি বেঁটে। মুখে বলেননি কিন্তু ইশারায় বলেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে নবীজি আয়েশা রাযি.-কে সম্বোধন করে বললেন, হে আয়েশা! আজ তুমি এমন একটি অন্যায় করেছ যার দুর্গন্ধযুক্ত বিষ কোনো সাগরে নিক্ষেপ করা হলে সমস্ত সাগর দুর্গন্ধ হয়ে যাবে।
ভেবে দেখুন, নবীজি ইঙ্গিতমূলক গীবতের ভয়াবহতা কিভাবে তুলে ধরলেন। অতঃপর তিনি বললেন, কেউ যদি আমাকে সারা দুনিয়ার ধন-সম্পদ দিয়ে দেয় এবং এর বিনিময়ে কারো প্রতি বিদ্রুপ করে তার নকল করতে বলে, যার উদ্দেশ্য হয় ওই ব্যক্তির বিদ্রূপ করা ও বদনাম ছড়ানো। তথাপি আমি কাজটি করতে প্রস্তুত নই। ( তিরমিজি শরিফ ২৬২৪)

গীবত সম্পর্কে সতর্ক থাকুন
বিদ্রূপ করা এবং তার নকল করা আজকাল বিনোদনের একটা অংশে পরিণত হয়েছে। যে এ ব্যাপারে বেশি পারদর্শী মানুষ তার প্রশংসা করে, তাকে ধন্যবাদ জানায়। অথচ মহা নবী  বলেছেন, কেউ যদি সারা পৃথিবীর ধন-সম্পদও আমাকে দিয়ে দেয় তবু আমি কারও নকল করতে প্রস্তুত নই।
এতে প্রতীয়মান হয়, নবীজি  কত গুরুত্বের সঙ্গে বিষয়টিকে বাধা দিয়েছেন। জানিনা, আমরা কেন মদপান ও ব্যভিচারের মতো গীবতকেও খারাপ মনে করি না। ঘৃণাও করি না; বরং গীবত আমাদের নিকট মায়ের দুধের মতই প্রিয়। আমাদের কোনো বৈঠক গীবতমুক্ত কাটে না। অথচ গীবত মদপান ও ব্যভিচারের চাইতে কোনো অংশে কম নয়। আল্লাহর ওয়াস্তে এই জঘন্য গুনাহ পরিহার করুন।

গীবত থেকে বাঁচবো কিভাবে
গীবত থেকে বাঁচার উপায় হল, এর মারাত্মক পরিণতি ও শাস্তির কথা হৃদয়ে বসাতে হবে। প্রতিজ্ঞা করতে হবে, জীবনে কখনো গীবত করব না। অতঃপর বিনয়ের সাথে আল্লাহর দরবারে দোয়া করতে হবে, ‘হে আল্লাহ! গীবত নামক জঘন্য গুনাহাটি থেকে আমি পরিত্রান চাই। বন্ধুবান্ধব ও আত্মীয়স্বজনের সঙ্গে গল্প করার সময় গীবত লিপ্ত হয়ে পড়ি; হে আল্লাহ! আমি শপথ করছি, ভবিষ্যতে কখনো গীবত করব না। কিন্তু আমার এই শপথ ঠিক রাখা এবং এর উপর বদ্ধপরিকর থাকা তোমার সাহায্য ও তৌফিক ছাড়া সম্ভব নয়। হে আল্লাহ! দয়া করে আমাকে গীবত থেকে বেঁচে থাকার সাহস, উৎসাহ ও তৌফিক দান করো।
আজই সাহস করে এভাবে শপথ ও দোয়া শুরু করুন।

গীবত না করার প্রতিজ্ঞা করুন
কোনো কাজ করার ইচ্ছা করলে তার উপর দৃঢ়সংকল্প করতে হয়। অন্যথায় কাজটি পূর্ণ করা যায় না। কারণ সকল নেক কাজের পথে শয়তান বাধার প্রাচীর হয়ে দাঁড়ায়। সে কাজকে পেছনে নিয়ে যেতে থাকে। সাথে সাথে প্ররোচনাও দিতে থাকে যে, ঠিক আছে, কাজটি আগামী দিন থেকে শুরু করা যাবে। কথিত ‘আগামী দিন’ এলে দেখা যায় নতুন আরেকটি ওযর সামনে এসে দাঁড়ায়। কাজ আর করা সম্ভব হয়ে উঠে না। তখন মনে মনে বলে, ঠিক আছে, আগামী দিন শুরু করা যাক। এভাবে ‘আগামী দিন’ শুধু ‘আগামী দিন’ থেকে যায়। আগামী দিন আর ‘বর্তমান’ হয় না। তাই কাজ করতে হলে সাথে সাথেই করতে হবে।
জাগতিক কর্মের বেলায়ও আমরা দেখি, যার আয়ের তুলনায় ব্যয় বেশি– সে আয় বাড়ানোর জন্য কেমন হাড়ভাঙ্গা মেহনত করে! ঋণী ব্যক্তি ঋণ পরিশোধ করার জন্য কত কষ্ট করে! অসুস্থ ব্যক্তি আরোগ্য লাভের জন্য কতইনা প্রচেষ্টা চালায়! অথচ আমাদের কী হলো, আমরা আমাদের বদভ্যাস ত্যাগ করতে পারি না এবং এর জন্য চিন্তিতও হই না!!!
নিজের অন্তরে অনুশোচনা জাগিয়ে তুলুন। ব্যাকুল ও অনুতপ্ত হয়ে দুই রাকাত সালাতুল হাজত পড়ুন। অনুনয়-বিনয়ের সাথে আল্লাহর দরবারে দোয়া করুন যে, হে আল্লাহ! আমি মন্দ কাজ পরিহার করতে চাই, আপনি দয়া করে আমাকে মন্দ কাজ থেকে বেঁচে থাকার তৌফিক দিন। আমাকে দৃঢ়তা দান করুন।
এভাবে দোয়ার পর বদ্ধপরিকর হবেন এবং প্রতিজ্ঞা পালনে নিজেকে বাধ্য রাখবেন।
হযরত থানবী রহ. বলেন, তবুও যদি কাজ না হয় তাহলে নিজের উপর কিছু জরিমানা নির্দিষ্ট করে নাও। যথা, এভাবে প্রতিজ্ঞা করবে যে, কোনো সময়ে গীবত হয়ে গেলে দু’রাকাত নফল নামাজ পড়বো অথবা আল্লাহর রাস্তায় এত টাকা দান করব। এভাবে আমল করলে ইনশাআল্লাহ ধীরে ধীরে গুনাহটি থেকে মুক্তি পাওয়া যাবে। এর জন্য অন্তরের ব্যকুলতাও থাকতে হবে। কঠিন রোগাক্রান্ত ব্যক্তি রোগমুক্তির জন্য যেরূপ ব্যাকুল থাকে ঠিক তদ্রূপ ব্যাকুল থাকতে হবে। কারণ এ বদ স্বভাব মারাত্মক একটি ব্যাধি। শারীরিক ব্যাধির চেয়েও মারাত্মক ব্যাধি। এটি মানুষকে জাহান্নামের অতলান্ত গহ্বরে নিক্ষেপ করে ছাড়ে। তাই গুনাহটি ছাড়তেই হবে। পরিবারকেও রক্ষা করতে হবে এ জঘন্য গুনাহ থেকে।
নারীদের মধ্যে গুনাহটির প্রচলন বেশি। দু-চারজন নারী একত্র হলেই শুরু হয় আলোচনা-সমালোচনা। এজন্য নারীরা সর্বপ্রথম প্রতিজ্ঞা নিতে হবে। তাহলে সংসার ও পরিবার গুনাহটি থেকে সহজে বাঁচতে পারবে।
আল্লাহ তাআলা আমাদের প্রত্যেককে আমল করার তৌফিক দিন। আমীন।

চোগলখুরি একটি মারাত্মক কবীরা গুনাহ
আরেকটি গুনাহের নাম চোগলখুরি। এটি গীবত থেকেও জঘন্য গুনাহ। আরবি ভাষায় এর নাম نميمة নামীমাহ। অনুবাদ করলে এর নাম হয়, চোগলখুরি। অর্থাৎ অপরের দোষ এজন্য বর্ণনা করা যেন শ্রোতা তার ক্ষতি করে। ক্ষতি যদি হয়েই যায় তাহলে বর্ণনাকারী বেশ খুশি হয় যে, বেশ ভালো হয়েছে, তার কষ্ট হয়েছে। বর্ণনাকৃত দোষটি বাস্তবেই ওই ব্যক্তির মাঝে পাওয়া যাক বা না যাক; শ্রবণকারী যেন কষ্ট দেয় এটাই উদ্দেশ্য। এরই নাম নামীমাহ তথা চোগলখুরি।

গীবতের চেয়েও বড় গুনাহ
কোরআন ও হাদিসে চোগলখুরির অনেক নিন্দাবাদ বর্ণিত হয়েছে। এটা গীবতের চেয়েও মারাত্মক। কারণ গীবতের মধ্যে খারাপ নিয়ত থাকে না। যার দোষ চর্চা করা হয় তার অনিষ্ট সাধনের নিয়ত থাকে না। পক্ষান্তরে চোগলখোরের মাঝে খারাপ নিয়ত থাকে। যার দোষ চর্চা করা হচ্ছে তার ক্ষতিসাধনের নিয়ত থাকে। সুতরাং এটি দুটি গুনাহের সমষ্টি। একটি হলো, গীবত। দ্বিতীয়টি হল, মুসলমান ভাইকে কষ্ট দেওয়ার নিয়ত। তাই কোরআন-হাদীসে এর ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে কঠোরবাণী এসেছে। কোরআন মজীদে ইরশাদ হয়েছে,

هَمَّازٍ مَّشَّاءٍ بِنَمِيمٍ

(কাফেরদের অবস্থা প্রসঙ্গে বলা হয়েছে) ওই ব্যক্তির মত চলে যে অন্যকে তিরস্কার করে, খোঁটা দেয় এবং একজনের কথা আরেকজনের কাছে লাগায়। হাদীস শরীফে এসেছে। নবীজি  বলেছেন,

لَا يدْخل الْجنَّة قَتَّات

চোগলখোর জান্নাতে প্রবেশ করবে না। (বুখারী শরীফ, কিতাবুল আদাব)

কবরের আজাবের দু’টি কারণ
হাদীস শরীফে বর্ণিত হয়েছে, একবার রাসুলুল্লাহ  সাহাবায়েকেরামকে নিয়ে কোথাও যাচ্ছিলেন। তখন রাস্তার পাশে দু’টি কবর দেখতে পেলেন। কবর দু’টির কাছে পৌঁছে তিনি সেদিকে ইঙ্গিত করে বললেন, এই দুই কবরবাসীর উপর আযাব হচ্ছে। (আল্লাহ তাআলা তাঁর নবী –কে আজাব দেখিয়ে দিয়েছিলেন। অন্যথায় হাদীস শরীফে এসেছে, কবরআজাব চলাকালে তার ভয়ঙ্কর আওয়াজ আল্লাহ তাআলা দয়া করে আমাদের থেকে গোপন রাখেন। কারণ ওই আজাব যদি মানুষ শুনত তাহলে কেউ জীবিত থাকতে পারত না। দুনিয়ার সবকিছু থেমে যেত। এজন্য আল্লাহ তাআলা এই আওয়াজ গোপন রেখেছেন। অবশ্য কোনো কোনো সময় মানুষের শিক্ষার জন্য প্রকাশ করে থাকেন।
যাই হোক অতঃপর তিনি সাহাবায়েকেরামকে জিজ্ঞেস করলেন, তোমরা জানো কি এই আজাব কেন হচ্ছে? তারপর নিজেই উত্তর দিলেন, দু’টি কারণে এদের উপর আযাব হচ্ছে । একজন পেশাবের ছিটা থেকে নিজের কাপড় এবং শরীরকে বাঁচাত না।
যে সময়ের কথা বলা হচ্ছে, সে সময় মানুষ উট- ছাগল চরানোর অভ্যাস ছিল। তারা উট-ছাগলের পাশে থাকতো। অনেক সময় ওদের পেশাবের ছিটা থেকে শরীর ও কাপড় রক্ষা করা যেত না। আর তা থেকে বেঁচে থাকার চেষ্টা ও সর্তকতা অবলম্বন না করার কারণে আজাব হচ্ছে। কারণ ইচ্ছে করলে এবং সতর্ক থাকলে এর থেকে বেঁচে থাকা কঠিন কিছু ছিল না। যেমন নরম স্থানে পেশাব করলে পেশাবের ছিটা থেকে সহজেই বাঁচা যায়। (মুসনাদে আহমদ খন্ড ৫ পৃষ্ঠা ৪৯)

পেশাবের ছিটা থেকে বাঁচা
আলহামদুলিল্লাহ, পবিত্রতার শিষ্টাচার ইসলামে সবিস্তারে শিক্ষা দেওয়া হয়েছে। বর্তমানে পাশ্চাত্য সভ্যতার অশুভ দাপটে মানুষ বাহ্যিক পরিছন্নতা তো মোটামুটি শিখে কিন্তু শরয়ী পবিত্রতার কিছুই শেখে না। বাথরুম এমনভাবে বানানো হয়, ইচ্ছে করলেও পেশাবের ছিটা থেকে বাঁচা মুশকিল হয়ে যায়। অথচ রাসূলুল্লাহ  বলেছেন,

اِسْتَنْزِهُوا مِنْ اَلْبَوْلِ, فَإِنَّ عَامَّةَ عَذَابِ اَلْقَبْرِ مِنْهُ

পেশাব থেকে বেঁচে থাকো। কারণ অধিকাংশ কবরের আজাব পেশাবের কারণে হয়ে থাকে।
পেশাবের ছিটা শরীর বা কাপড়ে লেগে গেলে কবরের আজাব হয়। সুতরাং এ থেকে অবশ্যই বেঁচে থাকতে হবে।

চোগলখুরি থেকে বেঁচে থাকা
ইমাম গাজ্জালী এহয়াউল উলুম গ্রন্থে লিখেছেন, কারো গোপন কথা বাদ তথ্য ফাঁস করে দেওয়াও চোগলখুরির অন্তর্ভুক্ত। যেমন কারো এমন কিছু কথা আছে অথবা এমন কোন বিষয় আছে, ভালো কিংবা মন্দ; যার প্রকাশ সে চায় না। অথচ আপনি বলে বেড়ালেন, ‘অমুকের এই এই সম্পদ আছে’। তাহলে এটাও চোগলখুরি। যা সম্পূর্ণ হারাম।
অথবা কেউ কোনো পারিবারিক পরিকল্পনা করেছে। তুমি কোনোভাবে সেটা জেনে ফেলেছো। আর তা বলে বেড়াচ্ছো তাহলে এটাও চোগলখুরির শামিল হবে। অনুরূপভাবে কারো গোপন তথ্য প্রকাশ করে দেওয়াও চোগলখুরির অন্তর্ভুক্ত। হাদীস শরীফে এসেছে,

المجالسُ بالأمانةِ
অর্থাৎ মজলিসের কথাবার্তা আমানত।

যেমন, কেউ আপনাকে বিশ্বস্ত ভেবে মজলিসে আপনার সামনে আলোচনা করল তাহলে এটা আমানত। আপনি যদি অন্যের কাছে বলে দেন তাহলে আমানতের খেয়ানত হবে এবং এটাও চোগলখুরি হবে।

জবানের দু’টি মারাত্মক গুনাহ
মোট কথা, আমরা এখানে জবান দ্বারা সংঘটিত দু’টি গুনাহর কথা আলোচনা করলাম। গুনাহগুলোর ভয়াবহতা আপনারা হাদিসের আলোকে জানতে পেরেছেন। এসব গুনাহ যে পরিমাণের জঘন্য, আমরা সে পরিমাণে উদাসীন। আমাদের জবান লাগামহীনভাবে চলেছে তো চলেছেই। থামার কোনো নাম নেই। আল্লাহর ওয়াস্তে মুখে লাগান। নিয়ন্ত্রণে রাখুন। আল্লাহ ও তাঁর রাসূলের বিধান মাফিক তাকে পরিচালিত করুন। এর কারণে আজ পরিবারের পর পরিবার বিরান হয়ে যাচ্ছে।
পরস্পর মতানৈক্য, ফিতনা-ফাসাদ ও শত্রুতা বেড়েই চলছে। কী আপন কী পর; সকলেই পরস্পরের দুশমনে পরিণত হচ্ছে। দুনিয়ার এসব ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও আখেরাতের মর্মন্তুদ শাস্তি তো আছেই। আল্লাহই জানেন, দুনিয়াতে এর কারণে কত ফেতনা জন্ম নিচ্ছে।
আল্লাহ আমাদের উপর দয়া করুন। এর ভয়াবহতা ও কদর্যতা উপলব্ধি করার তৌফিক দিন। বাঁচার উপায়সমূহের উপর আমল করার তৌফিক দিন। আমিন।

وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ

azadservice https://www.azadservice.com

WhatsApp : wa.me/8801933307999
Email: [email protected]
Call : +8801933307999
Youtube : https://www.youtube.com/@DropshippingService?sub_confirmation=1

You May Also Like

More From Author

+ There are no comments

Add yours